November 15, 2024, 7:37 pm

পদ বাঁচাতে বিএনপিপন্থীদের শরণাপন্ন এনআরবিসি চেয়ারম্যান

পদ বাঁচাতে বিএনপিপন্থীদের শরণাপন্ন এনআরবিসি চেয়ারম্যান

৫ আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের ফলে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর নিজেদের রঙ বদলাতে বিভিন্ন অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল, ভাইস চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মিয়াঁ আর্জু ও এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান আদনান ইমাম। ব্যাংকের বঞ্চিত কর্মকর্তারা যখন তাদের পদত্যাগের দাাবিতে আন্দোলন শুরু করে তখন নিজেদের পদ ধরে রাখতে তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসাবাদ ৫০ লাখ টাকা অনুদান দিয়ে ছাত্রদের অনুকম্পা নেয়ার চেষ্টা করে। এটা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হলে এখন তারা নিজেদের পদ টিকিয়ে রাখতে বিএনপির দ্বারস্থ হয়েছে। এ লক্ষ্যে তারা বিএনপিপন্থী দুইজন আইনজীবী নেতা ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের একজন উপদেষ্টাকে এনআরবিসি ব্যাংকের লিগ্যাল রিটেইনার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।

এনআরবিসি ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত ৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ১৮৯তম সভার মেমো নং ০৬ এর তথ্য অনুসারে এ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিনের প্রতিষ্ঠান জয়নুল আবেদিন এন্ড এসোসিয়েটস ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকনের প্রতিষ্ঠান মাহবুব এন্ড কোম্পানীকে ব্যাংকের লিগ্যাল রিটেইনার হিসেবে গত ১৪ আগস্ট নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অপর নেতা এ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে গত ৩ সেপ্টেম্বর নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ব্যাংকের রিটেইনার নিয়োগের বিষয়টি পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন সাপেক্ষে দেয়া হলেও, তড়িঘড়ি করে পর্ষদ মিটিংয়ের আগেই বিএনপির এই তিন নেতাকে মাসিক ৭৫ হাজার টাকা সম্মানীতে ১ বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে ৮ সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত পর্ষদ সভায় এই নিয়োগ পোস্ট ফ্যাক্টো হিসেবে অনুমোদন দেয়ার প্রস্তাব করা হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বিজনেস নিউজকে বলেন, আসলে আমরা আইনজীবী। কে আওয়ামী লীগ করে আর কে বিএনপি করে সেগুলো আমরা দেখি না। এখানে এনআরবিসি ব্যাংক আমার প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছে তাদের আইনের বিষয়গুলো দেখার জন্য। আমরা কাউকে রক্ষা করার জন্য কাজ করি না। আর ব্যাংকটির চেয়ারম্যান তার পদ ধরে রাখতে আমার প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছে-এমন অভিযোগ সঠিক না।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে নিজেদের রঙ বদলাতেই বিএনপির তিনজন কেন্দ্রীয় নেতাকে ব্যাংকের লিগ্যাল রিটেইনার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তাদের সুনজরে থাকার চেষ্টা করছেন পারভেজ তমাল, রফিকুল ইসলাম মিয়াঁ আর্জু ও আদনান ইমাম।

অভিযোগ রয়েছে, বিগত সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধু পরিষদ রাশিয়ার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নাম ভাঙ্গিয়ে এনআরবিসি ব্যাংক সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতির সাথে জড়িত ছিলেন ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মিয়াঁ আর্জু ও চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল। তাদেরকে সকল অপকর্মে সহায়তা দিয়েছেন এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান আদনান ইমাম। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে ও অপরাধের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে এবার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় তিন নেতার উপর চেপেছেন তমাল-আর্জু-আদনান।

নাম না প্রকাশের শর্তে ব্যাংকটির এক কর্মকর্তা জানান, ছাত্রজনতার হত্যাকারীর দোসর, তারাই কয়েকদিনের ব্যবধানে ছাত্রদের আর্থিক অনুদান প্রদানের নামে নিজেদের দালাল পরিচয়ের কবর দিতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। অথচ জুলাই মাসেই ছাত্রজনতার আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাবেক সভাপতি আল নাহিয়ান জয় ও ছাত্রলীগ নেত্রী তিলোত্তমা শিকদারকে ২৫ লক্ষ টাকার তহবিল প্রদানের কথা সর্বজন বিদিত।

ব্যাংক সুত্রে জানা যায়, গত সরকারের শাসনামলে ব্যাংকের নানা লুটপাটের সাথে জড়িত ছিলেন তমাল-আর্জু-আদনান সিন্ডিকেট। ব্যাংকটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, ২০১৮ সাল থেকে আর্থিক দুর্নীতির মহোৎসব চালাচ্ছেন এই তিন পরিচালক ও তাদের পোষ্য কর্মকর্তারা। দেশ ছেড়ে পালানো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিমের সহায়তায় ঋণ জালিয়াতি, কমিশন বানিজ্য, নিয়োগ বানিজ্য, শেয়ার কারসাজি, মানিলন্ডারিং, বিদেশে অর্থ পাচার, গ্রাহকের কোম্পানী দখলসহ বিবিধ আর্থিক দুর্নীতে লিপ্ত হয়েছেন এই তিন পরিচালক।

ব্যাংকসুত্রে আরো জানা যায়, গত ছাত্র- জনতার গণ অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর ০২ সেপ্টেম্বর সোমবার পর্যন্ত আত্মগোপনে ছিলেন এই তিন পরিচালক। সোমবার ছাত্রজনতার বিপ্লবের এক মাসপূর্তির আগেই নিজেদের শুদ্ধ প্রমাণ করতে ছাত্রদের অনুদান দেন, যা ব্যাংকটির বেশিরভাগ কর্মকর্তা – কর্মচারী ভালোভাবে গ্রহণ করেনি।

নাম না প্রকাশের শর্তে তারা বলেন, আওয়ামী শাসনামলে যারা ব্যাংকটি লুটপাট করেছে তারা এখনো দায়িত্বে থাকতে চেষ্টা চালাচ্ছে। এভাবে চলতে পারে না। ব্যাংকটি বাঁচাতে সংস্কার কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও সোস্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার সাইদ আব্দুল্লাহ নিজের ফেসবুকে লিখেন, ঝোঁপ বুঝে কোপ মেরে ছাত্রদের কাছে ইমেজ প্রতিষ্ঠিত করে ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসাবে টিকে থাকার রাস্তা ক্লিয়ার করার মিশনে আছে এই চেয়ারম্যান এবং ব্যাংকে তার ঘনিষ্ঠজনরা। আমি দুদক এবং দেশের সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকদের অনুরোধ করবো এনআরবিসি-র চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল এবং তার ঘনিষ্ঠজনদের বিরুদ্ধে জরুরি তদন্ত শুরু করতে। ঠিকঠাক তদন্ত করলে আরও অনেককিছুই পাবেন বলে আমার ধারণা।

খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এসএম পারভেজ তমালসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ থাকায় এবং ব্যাংক খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে শীঘ্রই এ ব্যাংকের পর্ষদও ভেঙ্গে দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। এমতাবস্থায় পর্ষদ টিকিয়ে রাখতে পারভেজ তমাল বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছেন। প্রথমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে ৫০ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন। আর এখন বিএনপির দ্বারস্থ হতে দলটির তিন আইনজীবী নেতাকে ব্যাংকটির লিগ্যাল রিটেইনার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে এডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসাইন আলালের নাম্বারে একাধিকবার ফোন দিলেও তারা রিসিভ করেন নি।

অপরদিকে এনআরবিসি ব্যাংকের এমডি রবিউল ইসলামের নাম্বারে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নি।

এনআরবিসির চেয়ারম্যান পারভেজ তমালের বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, বিধি লঙ্ঘন করে পদোন্নতি ও ইনক্রিমেন্ট প্রদান, পর্ষদ সভায় অতিরিক্ত ব্যয়, কোম্পানি খুলে তার মাধ্যমে এনআরবিসি ব্যাংকে চার হাজার চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ দেয়ার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া একই দিন সকালে লিখিত পরীক্ষা নিয়ে বিকেলে মৌখিক পরীক্ষা নেয়া এবং চেয়ারম্যানের ব্যবসায়িক অংশীদারের নামে বাজেয়াপ্তযোগ্য শেয়ারের মালিকানা নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ ছাড়া, ব্যাংকের কার্যক্রমে অন্যায়ভাবে তাদের হস্তক্ষেপ করার অভিযোগও উঠেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

অপরদিকে, এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল, ভাইস চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মিয়া আর্জু ও এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান আদনান ইমামের অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকটির উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার তোহেল আহমেদ, উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার সোনাওর আলী, উদ্যোক্তা পরিচালক মো. এনায়েত হোসেন, উদ্যোক্তা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, উদ্যোক্তা পরিচালক সারোয়ার জামান চৌধুরী, উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার এস এম গোলাম রব্বানী চৌধুরী ও উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার সাখাওয়াত আলীও একটি লিখিত অভিযোগ করেন।

এদিকে, ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্টের (এফআইএসডি) পক্ষ থেকে পরিদর্শন করা হলেও এখন পর্যন্ত এনআরবিসির চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট পরিচালকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এনআরবিসি ব্যাংকের সব অনিয়ম জানার পরও রহস্যজনক কারণে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগও উঠেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিরুদ্ধে। সব কিছু জেনেও এতদিন ধরে চুপ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এদিকে, বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বেশির ভাগ নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে এনআরবিসি ব্যাংকের বিরুদ্ধে। জনপ্রতি ৬ থেকে ৯ লাখ টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে এমন একটি অভিযোগের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিদর্শন করে অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে আসে, ১০৫ জন ট্রেইনি অফিসার নিয়োগের জন্য অনলাইনে আবেদন নেয়া হয়। ২০২২ সালের ৯ এপ্রিল পরীক্ষার জন্য মোট ৩০৪ প্রার্থীকে আমন্ত্রণ জানায় ব্যাংক।

সকালে লিখিত পরীক্ষা নিয়ে অস্বাভাবিক দ্রুততায় একই দিন বিকেলে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। যাদের নিয়োগ দেয়া হয়, তাদের মধ্যে ৯৬ জনের চাকরির বয়স শেষ পর্যায় তথা ২৯ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। চারজনের বয়স-সংক্রান্ত কোনো তথ্য ছিল না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল বলেছে, নির্বাচিত অধিকাংশের বয়স ২৯ বছরের বেশি হওয়া অস্বাভাবিক। এতে প্রমাণিত হয়, পূর্বনির্ধারিত ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতেই এমন পরীক্ষার আয়োজন করা হয়েছে। নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেয়া ১৫ জনের অনলাইন আবেদনও পাওয়া যায়নি। যদিও চেয়ারম্যানের টাকা নেয়ার অভিযোগ খতিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি, তবে পরীক্ষা নেয়ার অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া ও অপেশাদারিত্বের সঙ্গে প্রার্থী নির্বাচন করায় নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হয়ে থাকতে পারে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়। তারপর, এনআরবিসি ব্যাংকের মানবসম্পদ নীতিমালা অনুযায়ী, কর্মমূল্যায়নের ভিত্তিতে একজন কর্মকর্তাকে একবারে সর্বোচ্চ তিনটি ইনক্রিমেন্ট দেয়া যাবে। আবার পদোন্নতির জন্য অন্তত দুই বছরের এসিআর থাকতে হবে। কাজী মো. সাফায়েত কবির, মো. জাফর ইকবাল হাওলাদারসহ কয়েকজন কর্মকর্তার পদোন্নতির ক্ষেত্রে এ নিয়ম মানা হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে এসেছে, চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন ২৭ কর্মকর্তাকে চার থেকে ১৩টি পর্যন্ত ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয়েছে। কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা ছাড়াই ব্যাংকের বোর্ড সেক্রেটারিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে চেয়ারম্যানের অপছন্দের কয়েকজন কর্মকর্তাকে নানা উপায়ে চাপ প্রয়োগ করে ব্যাংক থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, চেয়ারম্যানের জন্য একটি অফিস বরাদ্দ দিতে পারে ব্যাংক। অথচ ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমালের মতিঝিলে প্রধান কার্যালয়ে এবং ব্যাংকটির গুলশান শাখায় একটি করে অফিস ব্যবহার করার তথ্য পেয়েছে পরিদর্শক দল। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে পরিচালনা পর্ষদের উচ্চ ব্যয়ের কিছু উদাহরণ দেয়া হয়েছে। একটি সভায় তিনজন পরিচালকের জন্য ২০ বাস্কেট ফল কিনে ৮৫ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়। আবার নির্বাহী কমিটির এক সভায় তিনজনের দুপুরের খাবার বাবদ ২০ পিস ইলিশ, ২০ পিস চিংড়ি ভুনা, ২০ পিস চিতল মাছ, ২০ পিস রূপচাঁদা মাছ কিনে খরচ দেখানো হয় ৫৮ হাজার ৬৫০ টাকা। এভাবে পর্ষদের প্রতি সভায় সম্মানী ভাতা ছাড়াই প্রত্যেক পরিচালকের পেছনে গড়ে ১৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ের তথ্য পেয়েছে পরিদর্শক দল, যা অস্বাভাবিক বলা হয়েছে।

জানা গেছে, ব্যাংকের চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তা, অফিস সহায়ক ও পুলের গাড়ি সরবরাহকারী নিয়োগের জন্য ২০১৮ সালে চেয়ারম্যানসহ ৯ জন পরিচালক মিলে ‘এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট’ নামে একটি কোম্পানি খোলেন, যার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০২১ সালের শুরু থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত তিন হাজার ৭১৪ কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। দরপত্র আহ্বান এবং অভিজ্ঞতা যাচাই ছাড়াই এসব নিয়োগের বিপরীতে সার্ভিস চার্জ বাবদ ব্যাংক থেকে ১১ কোটি ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন তারা। এ ছাড়া ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি এনআরবিসি ব্যাংক সিকিউরিটিজের ১০ শতাংশ শেয়ার কয়েকজন পরিচালক নিজেদের নামে নেন। এ দুটি ঘটনাকে নিয়মের পরিপন্থি ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব হিসেবে উল্লেখ করে দ-নীয় অপরাধ বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, কোনো জবাবদিহি না থাকায় এ কোম্পানির মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে ইচ্ছামাফিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০১৪ সাল ও ২০২২ সালের জুনের নির্দেশনায় পরিচালক বা তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাংকের কোনো পণ্য, সেবা ও সংগ্রহ বা কেনার নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠির পর সম্প্রতি তারা কোম্পানির শেয়ার অন্যদের নামে হস্তান্তর করেছেন। যদিও এসব শেয়ারের সুবিধাভোগী বর্তমান চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন পরিচালকই আছেন। এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের নামে বিভিন্ন সময়ে ঋণও দিয়েছে ব্যাংক। সেই ঋণের টাকা বেশির ভাগ সময় নামসর্বস্ব কোম্পানি লানতা সার্ভিস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্থানান্তর হয়েছে।

জানা গেছে, এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট ও স্টারলিংকস হোল্ডিংস বনানীর এডব্লিউআর এনআইবি টাওয়ারে অবস্থিত। এ ভবনের মালিকানায় রয়েছে ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান আদনান ইমামের এডব্লিউআর ডেভেলপমেন্ট। পারভেজ তমালের সব শেয়ার তারই ব্যবসায়িক সহযোগী স্টারলিংকস হোল্ডিংসের মালিক শফিকুল আলমের নামে হস্তান্তর করে তাকেই এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়েছে। শফিকুল আলমের প্রতিষ্ঠান রিলায়েবল বিল্ডার্সের নামে এনআরবিসি ব্যাংকের হাতিরপুল শাখায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। বিপুল অঙ্কের এ ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে রয়েছে বরিশালের আলেকান্দা মৌজায় অবস্থিত ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ জমি।

এনআরবিসি ব্যাংকের উদ্যোক্তা শেয়ার চলতি মার্চ পর্যন্ত লকইন তথা বিক্রি বা হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আবার ২০২১ ও ২০২২ সালের জন্য ঘোষিত বোনাস শেয়ারও ২০২৫ ও ২০২৬ সালের আগে বিক্রি করা যাবে না। অথচ নিয়ম অমান্য করে বিশেষ বিবেচনায় ব্লক মার্কেটে এই শেয়ার কেনাবেচার অনুমোদন দেয় বিএসইসি। এর মধ্যে গত ৩১ অক্টোবর ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমালের ব্যবসায়িক অংশীদার শফিকুল আলমের অনুকূলে এক কোটি ৬৫ লাখ ৭২ হাজার ৯৯২টি এবং নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আদনান ইমামের স্ত্রী নাদিয়া মোমিন ইমামের কাছে এক কোটি ৩৮ লাখ ৪৫ হাজার ৯০৪টি শেয়ার বিক্রি করা হয়। আর মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুল আহসানের মেয়ে রেহনুমা আহসানের অনুকূলে এক কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার ৬১৫টি শেয়ার হস্তান্তর করা হয়েছে।

এসআর

Please Share This Post in Your Social Media


Comments are closed.

© 2019 Businessnewsbs24.com
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com